সুরঞ্জিত নাগ :
ফেনীতে মাদকের ব্যাপক ছড়াছড়ি। সীমান্তবর্তী এ জেলার অলিগলি, পাড়া-মহল্লা, চায়ের দোকান যেখানে হাত বাড়ায় সেখানেই মিলছে ফেনসিডিল, হেরোইন, মদ ও গাঁজা। মরণ নেশা মাদক হুমকীরমুখে ঠেলে দিচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, যুব সমাজ ও উঠতি কিশোরদের সোনালী ভবিষ্যত। মাদক ব্যবসায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও জড়িয়ে পড়েছে। মাদকের এমন ভয়াবহতায় উদ্বিগ্ন অভিভাবকমহল। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হিসাব মতে, গত ৬ মাসে ফেনীতে বিজিবি, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিশেষ অভিযানে ৩৬ কোটি ৮ লাখ ৯০ হাজার ১৮০টাকা মূল্যের মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৪৫৬টি, আটক করা হয়েছে ৫৩৫ জনকে। যুব ও কিশোর সমাজকে মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে জেলার সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন প্রবেশমুখে কঠোর নজরদারি এবং জেলার অভ্যন্তরে মাদকদ্রব্য বেচা-কেনার স্থানসমুহ চিহ্নিত করে তা নির্মূলে কার্যকর প্রদক্ষেপ গ্রহণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি দাবি জানিয়েছেন সচেতনমহল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফেনী শহরের গুদাম কোয়ার্টার, রেলস্টেশন এলাকা, ট্রাংক রোডের পিটিআই গেট, জেল রোড, বিরিঞ্চি, জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া এবং দাগনভূঞা ও সোনাগাজীর বিভিন্ন হাট-বাজার, পাড়া-মহল্লায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে মাদকদ্রব্য। মাদকের এ ব্যবসার সাথে স্থানীয় বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকারও অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উদ্যোগে মাদকের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করা হলেও কোনেভাবেই প্রতিরোধ করা যেন সম্ভব হয়ে উঠছে না। মাদকের ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের দেয়া তথ্য মতে, গত ছয় মাসে মাদকদ্রব্য উদ্ধারের যে চিত্র পাওয়া গেছে তা রীতিমতো আঁতকে উঠার মতো। বিজিবি, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃক গত ছয় মাসে উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্য, মামলা ও আটকের তথ্য নি¤েœ দেয়া হল-
আগস্ট ২০১৬ :
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর : ৩০০পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, হেরোইন ২০ গ্রাম, গাঁজা ২২০ কেজি। মূল্য- ৩,৭০,২০০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ১১, মামলার সংখ্যা- ১০।
পুলিশ : ফেনসিডিল ১৫০ বোতল, গাঁজা ১,৫৫০ কেজি, ইয়াবা ট্যাবলেট ১২৭০ পিস, কোরেক্স ১৭ বোতল, বিদেশী মদ ১৬ বোতল, চোলাই মদ ১৮ লিটার, হুইস্কি ১০ বোতল, হেরোইন- ১৫ পুড়িয়া। মূল্য : ৮,২৭,৮০০/-
আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৪৭, মামলার সংখ্যা- ৩৯।
বিজিবি : ভারতীয় হুইস্কি- ২৮২৯ বোতল, ফেনসিডিল ১০ বোতল। মূল্য : ৪৫,৩৬,৫০০/-
আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ১, মামলার সংখ্যা- ১।
সেপ্টেম্বর ২০১৬ :
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর : ১৫৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ফেনসিডিল ৩১ বোতল, গাঁজা ৮২০ গ্রাম, বিদেশী মদ ১ বোতল। মূল্য- ১০,১,৯০০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৯, মামলার সংখ্যা- ১০।
পুলিশ : ফেনসিডিল ১৫৫ বোতল, গাঁজা ৭ কেজি ৪০০ গ্রাম, ইয়াবা ট্যাবলেট ৪৪৭০ পিস, কোরেক্স ৪১ বোতল, বিদেশী মদ ৫০ বোতল, বিয়ার ৪৭ বোতল,হুইস্কি ৭০ বোতল, হেরোইন ২৮ পুড়িয়া, বোতকা ৯ বোতল। মূল্য : ২৫,১০,৯০০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৭২, মামলার সংখ্যা- ৬৩।
বিজিবি : ভারতীয় হুইস্কি- ২৯৩৫ বোতল, ফেনসিডিল ৯৮৬ বোতল, বিয়ার ৩৫ বোতল, গাঁজা ৩৪ হাজার ১০০ কেজি। মূল্য : ৪৯,০৫,০০০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ১, মামলার সংখ্যা- ১।
অক্টোবর ২০১৬ :
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর : ফেনসিডিল ১১ বোতল, বিয়ার ২২ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট ১০৮ পিস, গাঁজা ৩৫০ কেজি, বিদেশী মদ ৩ বোতল। মূল্য- ১,২৬,৫০০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৮, মামলার সংখ্যা- ৯।
পুলিশ : ফেনসিডিল ১৫৯ বোতল, গাঁজা ১ হাজার ৫৫ কেজি ৯ পুড়িয়া, ইয়াবা ট্যাবলেট ১২৭০ পিস, কোরেক্স ১৭ বোতল, বিদেশী মদ ১৬ বোতল, হুইস্কি ১০ বোতল, দেশী চোলাই মদ ১৮ লিটার, হেরোইন ১৫ পুড়িয়া। মূল্য : ৮,২৭,৮০০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৭৮, মামলার সংখ্যা- ৮২।
বিজিবি : ভারতীয় হুইস্কি- ২৮৮৭ বোতল, ফেনসিডিল ৭৫১ বোতল, বিয়ার ১৫১ বোতল, কোরেক্স ৩ বোতল, গাঁজা ১ হাজার ৭২০ কেজি। মূল্য : ৪৬,৭৫,৮৭০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৬, মামলার সংখ্যা- ৫।
নভেম্বর ২০১৬ :
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর : ইয়াবা ট্যাবলেট ১৬০ পিস, গাঁজা ১ হাজার ১৫০ কেজি। মূল্য- ৯১,৫০০/-
আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ১১, মামলার সংখ্যা- ১০।
পুলিশ : ফেনসিডিল ৪৭৫ বোতল, গাঁজা ১২ কেজি ৩২০ গ্রাম ১১৩ পুড়িয়া, ইয়াবা ট্যাবলেট ৬৩৯৫ পিস, কোরেক্স ৩৫ বোতল, বিদেশী মদ ৩১ বোতল, চোলাই মদ ২৫ লিটার,হুইস্কি ৮ বোতল, হেরোইন- ১৫ পুড়িয়া, বিয়ার ৩ বোতল। মূল্য : ৩৭,৪৭,৭১০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৮৮, মামলার সংখ্যা- ৭৮। বিজিবি : ভারতীয় হুইস্কি- ২৫৫৬ বোতল, ফেনসিডিল ১৬২ বোতল, বিয়ার ৭৭ বোতল, কোরেক্স ২৩ বোতল, গাঁজা ৪ হাজার ৮০০ কেজি, চোলাই মদ ৬৫ লিটার। মূল্য : ৩৯,৬৩,৫৫০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ২, মামলার সংখ্যা- ২।
ডিসেম্বর ২০১৬ :
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর : ফেনসিডিল ৪০ বোতল, বিয়ার ২২ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট ১৭৫ পিস, গাঁজা ১২০ কেজি, অপিরেটডিং কস ৭০০ বোতল, ডিনেচার্ড স্পিরিট ১৫ লিটার। মূল্য- ১,৭৯,৭০০/-।আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৯, মামলার সংখ্যা- ৯।
পুলিশ : ফেনসিডিল ৬০ বোতল, গাঁজা ১৬ কেজি ৮২০ গ্রাম, ইয়াবা ট্যাবলেট ৯৪৯ পিস, কোরেক্স ৪৮ বোতল, বিদেশী মদ ২১ বোতল, হুইস্কি ৯ বোতল, হেরোইন- ২৩ পুড়িয়া, বিয়ার ৩ বোতল। মূল্য : ৭,৭১,৩০০/-
আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৯১, মামলার সংখ্যা- ৫৯।
বিজিবি : ভারতীয় হুইস্কি- ২০৮৭ বোতল, ফেনসিডিল ১৭৬ বোতল, বিয়ার ১৫ বোতল, গাঁজা ৫ কেজি। মূল্য : ৩২,২২,১৫০/-। আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ২, মামলার সংখ্যা- ২।
জানুয়ারি ২০১৭ :
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর : গাঁজা ২ হাজার ৭০০ গ্রাম, ইয়াবা ট্যাবলেট ৭পিস। মূল্য- ৩০,৫০০/-
আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৫, মামলার সংখ্যা- ৫।
পুলিশ : ফেনসিডিল ৬৪৭ বোতল, গাঁজা ১৮ কেজি ৪৭০ গ্রাম ২০ পুড়িয়া, ইয়াবা ট্যাবলেট ২৬১৫ পিস, কোরেক্স ১৬ বোতল, বিদেশী মদ ১৫ বোতল, হুইস্কি ১৮ বোতল, হেরোইন- ২৩ পুড়িয়া, বিয়ার ২৪ বোতল, চোলাই মদ ২৫ লিটার, বোতকা ১২ বোতল। মূল্য : ১৩,৮৮,৪৫০/-
আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ৯২, মামলার সংখ্যা- ৬৯।
বিজিবি : ভারতীয় হুইস্কি- ২৫৯০ বোতল, ফেনসিডিল ৯০০ বোতল, বিয়ার ১০ বোতল, গাঁজা ১৩০০ কেজি, হিরোইন ৪ পুড়িয়া, ইয়াবা ৯৬০ পিস। মূল্য : ৪৬,১২,৮৫০/-
আটককৃত ব্যক্তির সংখ্যা- ২, মামলার সংখ্যা- ২।
এ প্রসঙ্গে ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার প্রফেসর তায়বুল হক বলেন, মাদক ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ। বিশেষ করে যুব সমাজ ও উঠতি তরুণ, লেখাপড়া কম জানা বস্তিতে বসবাস করে এমন ছেলে-মেয়েরা ও তাদের অভিভাবকরা মাদকাসক্ত ও মাদকের ব্যবসা করে। মাদক ফেনীতে উৎপাদন হয় না। এটি ফেনী ও দেশের বাইরে থেকে আসে। মাদক যাতে ফেনীতে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া দেশে প্রচলিত মাদক আইনের দুর্বলতা দুর করে, আরো কঠিন করতে হবে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে বেশি বেশি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় মাদক বিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার বলেন, পুলিশ প্রশাসন মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স অবস্থান। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক আশ্রয়দাতা সে যেই হোক তাকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। পুলিশের কোনো সদস্য যদি মাদকাসক্ত বা মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত এমন কোনো অভিযোগের প্রমাণ মেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থ নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার সোহেল রানা বলেন, জেলা প্রশাসন মাদকের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থানে রয়েছে। যে কোন মূল্যে মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক সিন্ডিকেটকারীদের উৎখাত করা হবে। মাদক প্রতিরোধে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- » বাংলাদেশ সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ ফেনী জেলা আহবায়ক কমিটি গঠিত
- » ফেনী বন্ধুসভার বৃক্ষরোপণ ও বিতরণ
- » আমার দেশ সম্পাদকের রত্নগর্ভা মাতা অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগমের মাগফিরাত কামনায় ফেনীতে দোয়া
- » গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদে ফেনীতে সাংবাদিকদের মানববন্ধন
- » ফেনীতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাংবাদিকদের উপর হামলার গোপন পরিকল্পনা ফাঁস
- » জনতার অধিকার পার্টির চেয়ারম্যানের উপর হামলা, সংবাদ সম্মেলন
- » ফেনী পৌর বিএনপির সদস্য নবায়ন কর্মসূচি উদ্বোধন
- » ফেনীতে হেফাজতের দোয়া মাহফিলে আজিজুল হক ইসলামাবাদী- ‘আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ থাকলে দেশে আর ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি হবে না’
- » ফেনীতে হাফেজ তৈয়ব রহ. স্মরণে দোয়ার মাহফিল
- » ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে ফেনীতে বিএনপি’র বর্ণাঢ্য বিজয় মিছিল, সমাবেশ “গণহত্যার দ্রুত বিচার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি”